Wednesday, April 11, 2018

কোটাপদ্ধতি বাতিল!!!



কোটা সংস্কারের আন্দোলনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বুধবার জাতীয় সংসদে এ নিয়ে কথা বলেছেন। সরকারদলীয় সাংসদ জাহাঙ্গীর কবির নানকের বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আলোচনা হলো, একটি সুনির্দিষ্ট তারিখ দিল, কেবিনেট সেক্রেটারিকে আমি দায়িত্ব দিলাম। তারা সে সময়টা দিল না। মানি না, মানব না বলে তারা যখন বসে গেল, আস্তে আস্তে সব তাদের সঙ্গে যুক্ত হলো। খুব ভালো কথা, সংস্কার সংস্কার বলে...সংস্কার করতে গেলে আরেক দল এসে বলবে আবার সংস্কার চাই। কোটা থাকলেই সংস্কার। আর কোটা না থাকলে সংস্কারের কোনো ঝামেলাই নাই। কাজেই কোটা পদ্ধতি থাকারই দরকার নাই। আর যদি দরকার হয় আমাদের কেবিনেট সেক্রেটারি তো আছেন। আমি তো তাঁকে বলেই দিয়েছি, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বসে তাঁরা কাজ করবেন। সেটা তাঁরা দেখবেন। আমি মনে করি, এ রকম আন্দোলন বারবার হবে। বারবার শিক্ষার সময় নষ্ট হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে ইউনিভার্সিটিগুলোতে ক্লাস বন্ধ। পড়াশোনা বন্ধ। এরপর আবার ভিসির বাড়ি আক্রমণ। রাস্তাঘাটে যানজট। মানুষের কষ্ট। সাধারণ মানুষের কষ্ট। সাধারণ মানুষ বারবার কষ্ট পাবে কেন? এই বারবার কষ্ট বন্ধ করার জন্য, আর বারবার এই আন্দোলনের ঝামেলা মেটাবার জন্য কোটাপদ্ধতি বাতিল। পরিষ্কার কথা। আমি এটাই মনে করি, সেটা হলো বাতিল।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘খুব দুঃখ লাগে যখন দেখলাম, হঠাৎ কোটা চাই না। কোট সংস্কারের আন্দোলন। আন্দোলনটা কী? লেখা পড়া বন্ধ করে দিয়ে রাস্তায় বসে থাকা। রাস্তায় চলাচল বন্ধ করা। এমনকি হাসপাতালে রোগী যেতে পারছে না। কর্মস্থলে মানুষ যেতে পারছে না। লেখাপড়া-পরীক্ষা বন্ধ করে বসে আছে। এ ঘটনা যেন সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। ডিজিটাল বাংলাদেশ আমিই গড়ে তুলেছিলাম। আজকে ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউব, যা কিছুই ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলো তো আমাদেরই করা। আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষা দেব, সে শিক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু গঠনমূলক কাজে ব্যবহৃত না হয়ে সেটা গুজব ছড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। একটা ছেলের মাথায় আঘাত লেগেছে। হঠাৎ একজন স্ট্যাটাস দিয়ে দিল যে সে মারা গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমেয়ে সব বেরিয়ে গেল।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘রাত একটার সময় হলের গেট ভেঙে মেয়েরা বেরিয়ে এল। শুধু একটি গুজবের ওপর। সে ছেলে যখন বলল আমি মরি নাই, বেঁচে আছে, তখন তাদের মুখটা থাকে কোথায়। এই স্ট্যাটাসটা কে দিল? কেন দেওয়া হলো। এই যে মেয়েরা বেরিয়ে এসেছে, অঘটন ঘটলে কে দায় নিত। সবচেয়ে ন্যক্কারজনক হলো ভিসির বাড়িতে আক্রমণ। আমরা তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। সব আন্দোলনে সেখানে ছিলাম। স্কুল–কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি আন্দোলন করতে। কখনো ভিসির বাড়িতে গিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ভাঙচুর করতে পারে, সে ভাঙচুরটা কী? ছবি দেখে মনে পড়ছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেভাবে আমাদের ৩২ নম্বরে ভাঙচুর করেছিল, ঠিক একই কায়দায়। এমনকি লকার ভেঙে গয়নাগাটি চুরি করা, টাকাপয়সা চুরি করা থেকে শুরু করে বাথরুমের কমোড খুলে রাখা, ভেঙে চুরমার করে দেওয়া। ভিসি, তাঁর স্ত্রী, ছেলেমেয়ের ওপর আঘাত পর্যন্ত করতে গিয়েছিল। যদিও অন্য ছেলেরা তাঁকে বাঁচিয়েছে। ছেলেমেয়েদের ভয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে তাদের। একতলা–দোতলা সব তছনছ। শুধু তা–ই নয়, তারা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সিসি ক্যামের ভেঙেছে। রেকর্ডিং বক্সটা পর্যন্ত সরিয়ে নিয়ে গেছে। কত পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আমি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই এবং যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না বা ছাত্র বলে আমি মনে করি না। কারণ কোনো শিক্ষার্থী তার শিক্ষককে এভাবে অপমান করতে পারে না, আঘাত করতে পারে না। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। সব থেকে জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। এটা কী ধরনের কথা।’
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ‘তারা দাবি করেছে, খুব ভালো কথা। আমরা তো বসে নেই। সোমবারে কেবিনেটে বসে এ বিষয়টি আলোচনা করলাম। আমাদের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাদের সঙ্গে বসবে এবং বসল। সেই সঙ্গে আমি কেবিনেট সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিলাম এটা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করুন। যাকে যাকে দরকার, তাদের নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করুন। যে দাবিটা করেছে, তা কতটুকু কী করা যায়। আর মন্ত্রী তাদের সঙ্গে বসল। সমঝোতা হলো। অনেকে মেনে নিল, অনেকে মানল না। সারা রাত অনেক ছাত্রছাত্রী টিএসসিতে থেকে গেল। কেন? আলোচনা হচ্ছে, আন্দোলন চালানোর কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে। তা ছাড়া ভিসির বাড়ি ভাঙা, রাস্তায় আগুন দেওয়া। এমনকি মঙ্গল শোভাযাত্রার জিনিস পুড়িয়ে তছনছ।’
তিনি বলেন, ‘মেয়েরা যে এত রাতে হল থেকে বেরিয়ে এল। মাননীয় স্পিকার, আমি সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। আমি বারবার ফোন করেছি। আমি সঙ্গে সঙ্গে নানককে পাঠিয়েছি। সে ওখানে গেল। প্রেসকে বলল। আলোচনা করল। তারপরও তারা কোনো কিছু মানল না। এমনকি ঢাকার বাইরে সবাই রাস্তায় নেমে গেল। কী, কোটা সংস্কার। এ দাবি একবার না আরও অনেকবার এসেছে। আমরা একটি নীতি নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করি। আমাদের ছেলেমেয়ে যারা করছে, আমাদের ছেলেমেয়ে কেন, অনেকে আমার নাতির বয়সী। তাদের কিসে মঙ্গল হবে না হবে, আমরা কি বুঝি না? ১৯৭২ সাল থেকে এ কোটাপদ্ধতি চলছে। সময়-সময় সংস্কার করা হয়েছে। কোটা যা–ই থাক, সব সময় কোটা পূরণ হয় না। যে তালিকা থাকে, সেখান থেকে তাদের চাকরি দিয়ে দিই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৩৩তম বিসিএসে মেধার ভিত্তিতে ৭৭.৪০ শতাংশ নিয়োগ পেয়েছে। ৩৫তম ৬৭.৪৯, ৩৬তম ৭০.৩৮ ভাগ। মেধাবীরা বাদ যায়নি। কোটায় প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধার থেকে পূরণ করা হচ্ছে। সবাই মেধাবী। রিটেনে পাস করতে হয়। বিসিএস যারা দেয়, তারা সবাই মেধাবী। কোটায় যারা, তারাও একসঙ্গে পরীক্ষা দেয়। রিটেনে তাদের পাস করতে হয়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্দোলনকারীদের একটি দাবিতে বলা আছে, যেখানে কোটায় পাওয়া যাবে না, মেধা থেকে দেওয়া হবে। এটা তো হচ্ছে। আমার দুঃখ লাগে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো প্রফেসর বা অন্য বিশ্ববিদ্যালয় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, তাঁরা আবার একই সুরে কথা বলছেন। তাঁরা দেখেনই নাই আমরা মেধাতালিকা থেকে নিয়োগ দিচ্ছি। না হলে ৭৭ ভাগ কোথা থেকে। কোটায় যারা পাচ্ছে, তারাও মেধাবী। তার মানে শতভাগ মেধাবী। তারপরও আন্দোলন। তাহলে ঠিক আছে, আজকে সকালে আমার কাছে যখন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এল, আমরা তিন দিন ধরে ঘুমাতে পারছি না। এই চৈত্রের রোদের মধ্যে ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় বসে আছে, এই রোদে বসে থাকলে তো তাদের অসুখ–বিসুখ হবে। রাস্তা বন্ধ করে রাখছে। এমনি তীব্র যানজট, রোগী যেতে পারছে না হাসপাতালে, গাড়িতেই মারা যাচ্ছে। কেউ অফিস–আদালতে যেতে পারছে না। জেলা কোটা আছে। জেলায় জেলায় যে ইউনিভার্সিটি, সেখানেও তারা রাস্তায় নেমে গেছে। জেলায় যারা, তারাও চায় না। এরাও চায় না। তাহলে আমি বলে দিয়েছি বলো, কোনো কোটাই থাকবে না। কোনো কোটার দরকার নেই। ঠিক আছে, বিসিএস যেভাবে পরীক্ষা হবে, মেধার মাধ্যমে সব নিয়োগ হবে। এতে তো আপত্তি থাকার কথা নয়। আমরা কোনো শ্রেণি যাতে বঞ্চিত না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখে আমাদের সংবিধানে আছে, সেদিকে লক্ষ রেখে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, নারীরা—এখন দেখি মেয়েরাও নেমে গেছে রাস্তায়। ধরে নেব তারা কোটা চায় না। যখন আলোচনা হয়েছে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে, বৈঠকে বলে দিয়েছে তারা কোটা চায় না। আমি খুব খুশি। আমি নারীর ক্ষমতায়নে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা চায় না, তাহলে দরকারটা কী। কোটাপদ্ধতিরই দরকার নেই। যারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, তাদের অন্যভাবে চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারব। এই আন্দোলন যারা করেছে, যথেষ্ট হয়েছে, এখন তারা ক্লাসে ফিরে যাক। ভিসির বাড়ি যারা ভেঙেছে, লুটপাট করেছে, লুটের মাল কোথায় আছে, কার কাছে আছে, ছাত্রদেরই তো বের করে দিতে হবে। যারা ভাঙচুরে জড়িত, তাদের অবশ্যই বিচার হতে হবে। ইতিমধ্যে গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। ছাত্র–শিক্ষকের সহযোগিতা চাই। এত বড় অন্যায় আমরা মেনে নিতে পারি না। এখনো শিক্ষক যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের সম্মান করি। গুরুজনকে অপমান করে প্রকৃত শিক্ষা হয় না।’
এর আগে সম্পূরক প্রশ্নে নানক প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ সুযোগ নিয়ে কিছু তথাকথিত সুবিধাবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধী গণধিক্কৃত গোষ্ঠী ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে রাতের আঁধারে বর্বরোচিত হামলা চালানো হয়েছে। এ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর নারকীয়তাকেও হার মানিয়েছে। এই কোটাপদ্ধতি নিয়ে ওবায়দুল কাদের আপনার মনোভাব জানিয়েছেন। আন্দোলনকারীরাও সাধুবাদ জানিয়েছেন। এরপরও লক্ষ করছি, অতীতের মতো পরাজিত, মতলববাজ, দুষ্টচক্র অর্থপাচারকারী দল গুজব, উসকানি ছড়িয়ে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট বক্তব্য জানতে চাইছি। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট বক্তব্য জানতে চান।


(Source: Prothom Alo)

Tuesday, April 10, 2018

মায়ের চিকিৎসার টাকা মা দেবে, আমারে বলেন কেন?

মায়ের চিকিৎসার টাকা মা দেবে, আমারে বলেন কেন?



মনটা কদিন ধরেই ভালো নেই। অবশ্য যে অদ্ভুত দেশে বসবাস করি সেদেশে মনমেজাজ একটানা ভালো থাকবে সেটাও অস্বাভাবিক। মন খারাপ হলে আপনারা কে কী করেন সেটা জানি না, তবে আমি কি করি-সেটা বলতে পারি।
প্রথমেই মোবাইলটা অফ করি, মাঝে মাঝে রমনা পার্কের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বসে থাকি, কিছু বাদাম ছড়িয়ে দিলে দুয়েকটা কাঠবিড়ালী চলে আসে, এরা কী আশ্চর্য সুন্দর করে বাদামগুলো দুহাতে ধরে নিয়ে খায়! এদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনটা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসে।
মন খারাপের ব্যক্তিগত নানা ঘটনা বাদ থাকুক, চিকিৎসক হিসেবে যে কারণে মন খারাপ -সে ঘটনাটা বলি…

সেই দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। সকাল সকাল এক যুবক সাথে করে এক বয়স্ক মহিলা ও এক তরুণীকে নিয়ে আমার চেম্বারে প্রবেশ করলেন। বয়স্ক মহিলাটি হাই-প্রেশারের রোগী, বিষয়টা নিয়ে যুবক ও তরুণী বেশ উদ্বিগ্ন। প্রেশার চেক করলাম, একটু বাড়তির দিকে। বয়স্ক মহিলাটি প্রেশারের ওষুধ খাচ্ছেন, ডোজটা বাড়িয়ে দিয়ে কি করতে হবে আর কি করা যাবে না সে ব্যাপারে কিছু কথা বলে রোগীটি দেখা শেষ করলাম।
যুবকটি আমার প্রতিটা কথা বেশ দায়িত্ব নিয়ে বুঝে নিলেন, আমার সামনেই বেশ তরল গলায় বয়স্ক মহিলাকে কয়েকবার ‘মা’, ‘মা’ডেকে তাকেও বুঝিয়ে দিলেন। তাদের কথোপকথনে বুঝতে পারলাম বয়স্ক মহিলাটি তার শাশুড়ি, তরুণীটি তার স্ত্রী।
যুবকের রেসপনসিবিলিটিতে আমিও তখন বেশ মুগ্ধ, এমনকি মহিলার সামনেই বলে ফেললাম, ‘আপনার ভাগ্য তো বেশ ভালো! এমন জামাই কি সবার ভাগ্যে জোটে?’
মহিলা ও তরুণী হাসিমাখা মুখে সেটা স্বীকারও করে নিলেন।
যুবকটি ভিজিট দিয়ে বের হয়ে যাবার সময় আমাকে জানালেন ঘন্টাখানেক পর যুবকটির মা’ও আসবেন, আমি যেন একটু দেখে দেই…

যুবকটির মায়ের কথা রোগী দেখতে দেখতে ভুলে গেলাম। চেম্বার শেষ করে উঠতে যাবো, এমন সময় এক বৃদ্ধ মহিলা রুমের দরজা ও দেয়াল ধরে ধরে আমার রুমে ঢোকার চেষ্টা করলেন। আমার মনে আছে ঐ বৃদ্ধা বেশ দুর্বল ছিলেন, উনাকে চেয়ারে বসানোর জন্য আমাকে উঠে যেতে হয়েছিলো।
এই বৃদ্ধা আসলে ঐ যুবকটির মা। ডায়াবেটিস, হাই প্রেশার, শ্বাসকষ্ট আগে থেকেই ছিলো, ইদানিং পায়ে পানি চলে আসছে, সে কারণেই ডাক্তারের কাছে আসা। অনিয়মিতভাবে চিকিৎসা নিতেন। প্রেসক্রিপশনে ওষুধ লিখে কিডনী সংক্রান্ত দু’তিনটা পরীক্ষা দিতে হলো। ভিজিট দেবার সময় উনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন, অবাক হয়ে বলেছিলেনঃ ” আমার বাজান কি টাকা দিয়া যায় নাই!”
আমাকে বলতে হয়েছিলোঃ ” আপনার ছেলের মনে হয় ভুল হয়েছে। সমস্যা নেই, পরেরবার আসলে আপনার ছেলে থেকে নিয়ে নিব…”
তবে ছেলে যে ভুল করেনি সেটা পরে বুঝতে পেরেছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম ছেলের ভিজিট না দেয়াটা ছিল ইচ্ছাকৃত…

মাসদুয়েক পর যুবক আবারও এসেছিলেন তার শাশুড়িকে নিয়ে, আগের মতই শাশুড়ির চিকিৎসা নিয়ে তিনি ছিলেন বেশ উদ্বিগ্ন। চলে যাবার সময় একান্তে ডেকে তার মায়ের ভিজিটের কথা বললাম। উনি উষ্মার স্বরে যে উত্তর দিয়েছিলেন সেটা আপনাদের শোনাইঃ “মায়ের চিকিৎসার টাকা মা দিবে, আমারে বলেন কেন?”
অপেক্ষাকৃতভাবে সুস্থ শাশুড়িকে নিয়ে স্ত্রী সমেত যুবকটি হাজির হতে পারলেও ছানি পড়া অধিকতর দুর্বল নিজের জন্মদাত্রীকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসার সময় যুবকটির হয় নি। শাশুড়ির ক্ষেত্রে ভিজিট দিতে যুবকটি কার্পণ্য করেনি, কৃপণতা তিনি দেখিয়েছেন তার জন্মদাত্রীর প্রতি…
বৃদ্ধা মহিলা পরবর্তীতে আরো দু’বার সম্পূর্ণ একা একাই আমার কাছে এসেছিলেন, একা না এসে উপায়ও নেই, স্বামী মারা গিয়েছে অনেকদিন আগে। ততদিনে পায়ের ফোলা আরো বেড়েছে, তেমন কোন ওষুধও নেন নি, পরীক্ষাগুলোও করান নি। কেন ওষুধ ঠিকমত নেন না জিজ্ঞেস করাতে বলেছিলেন, ‘বাজান তো ওষুধ কিন্যা দেয় না। ওর কি দোষ কন! বউ-বাচ্চা নিয়া কত খরচের সংসার!’
বৃদ্ধা এর পরে যে দু’বার এসেছিলেন সে দু’বারই সর্বমোট ২০০-৩০০ টাকা হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছিলেন, আমার ভিজিটটাও দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, “বাজান” কে হয়ত ভিজিট সংক্রান্ত ব্যাপারে ডাক্তারের সামনে আর অপমানিত হতে দিতে চাননি। আমার সঙ্গেবৃদ্ধার আর দেখা হয় নাই…

এসব ঘটনার পর সাত-আট মাস পার হয়েছে। গত শুক্রবার ঐ যুবক আবারো তার শাশুড়ি আর স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন। শাশুড়ি সংক্রান্ত ব্যাপারে উনার তৈলাক্ত ভাব আরো বেড়েছে। প্রেসক্রিপশন লেখা শেষে কৌতুহল বশত একবার জিজ্ঞেস করলাম: ‘আপনার মা কেমন আছেন?’ উনি আনন্দিত চেহারা নিয়ে বললেন (I repeat, উনি আনন্দিত চেহারা নিয়েই কথাটা বলেছিলেন): “মা তো মারা গেছে আরো মাস চারেক আগে! মারা গিয়া অবশ্য ভালোই হইছে, তার জন্যে সবার অনেক কষ্ট হইতেছিলো”

আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো, ক্ষণিকের জন্য থমকে গেলাম। আহারে! যে মা তাকে “বাজান” ছাড়া কখনও সম্বোধন করেন নাই, সেই “বাজানে”র কথাটা কি ঐ মা পরপার থেকে শুনতে পেয়েছেন? ঐ মা কি শুনতে পেয়েছেন যে মৃত্যুর আগমুহূর্তে তার জন্য নাকি সবার কষ্ট হচ্ছিলো? “বাজান”-কে কষ্ট থেকে মুক্ত করতেই কি তিনি তাড়াতাড়ি ওপারে চলে গেলেন? আমার চিন্তার রাজ্য কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেলো।

প্রেসক্রিপশন নিয়ে বৃদ্ধার ছেলে হাসিমুখে তার শাশুড়িকে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। মনে অনেক কথা ছিলো, মুখে কিছু বলতে পারলাম না। ক্লান্ত পথিকের মত ঝিম মেরে তাদের গমন পথের দিকে চেয়ে রইলাম, পথিক শুধু দেখে যায়, কিছু বলা তার শোভা পায় না…

চিকিৎসক হিসেবে সবচেয়ে কঠিন কাজ কি জানেন? মানুষের সঙ্গে সঙ্গেমানুষরূপী কিছু অমানুষের চিকিৎসাও আমাদের করতে হয়। সে বড় কঠিন কাজ!

চিকিৎসকদের আপনারা পশু বলেন, অমানুষ বলেন–তাতে এখন খুব একটা কষ্ট পাই না, আপনারা মানুষ থাকলেই আমরা অনেক খুশি। দিনের পর দিন শত-সহস্র সত্যিকার মানুষদের চিকিৎসা দিতে আমরা চিকিৎসকরা কিন্তু ক্লান্ত হই না, “মানুষরূপী অমানুষ”দের চিকিৎসা দিতে আমাদের যে বড্ড কষ্ট হয়…

লেখক: ডা. জামান অ্যালেক্স, বিসিএস মেডিকেল অফিসার


কনটেন্ট ক্রেডিট: মেডিভয়েস